বিডিআর হত্যাকান্ড তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান। আমরা সবাই এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু কতোজন জানি যে, জেনারেল ফজলুর রহমান স্যারকে গত ১৫ টি বছর কি অসহনীয় জীবনযাপন করতে হয়েছে?
২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকান্ডের পর জে. ফজলুর রহমান স্যার কয়েকটি টিভিতে তাঁর জোরালো অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। ব্যস, তদানীন্তন ডিজিএফআই তাঁর পিছনে লেগে যায় ভয়াবহভাবে। সরকার চরম ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। স্যারকে দেশের সকল সেনানিবাসে অবাঞ্ছিত (পিএনজি) ঘোষণা করা হয়। তাঁর চিকিৎসা সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। তিনি সিএমএইচে এই বৃদ্ধ বয়সে কোন চিকিৎসা পাননি। কোন সেনানিবাসে তিনি যেতে পারতেন না। সকল সেনানিবাসের প্রবেশ দ্বারে তাঁর ছবি টাঙ্গানো থাকতো মিলিটারি পুলিশের রুমে। যারা পিএনজি হন তারা চাকুরিরত সেনা কর্মকর্তাদের সাথে তো বটেই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সাথেও দেখা সাক্ষাত করতে পারেন না। যদিও আমরা সকল অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সেটা ভঙ্গ করে তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতাম।
দীর্ঘদিন চাকুরি করার পর ও একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও জে. ফজলুর রহমানকে এই অপমান সহ্য করতে হয়েছে। কোন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখিনি বা কোন চেতনাওয়ালাকে বলতে শুনিনি যে একজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসার এমন সমস্যা বা অপমানের সম্মুখিন কেন!
এবছরও স্যার তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে সিএমএইচ-এ যাবার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু যেই অফিসারের সাথে কথা বলেন তিনি পরে ‘নাই’ হয়ে যান! ভাবখানা এমন যে পিএনজি জে. ফজলুর সাথে কথা বললে তার চাকুরি চলে যাবে! এছাড়া তাঁর নিরাপত্তা সংকটও দেখা দেয়। স্যারকে খুবই সাবধানে থাকতে হতো তার বাসায়। বের হতেন কম। অথচ তাঁর ভক্ত সমর্থকের সংখ্যা সেনাবাহিনীতে অগনিত।
যাহোক, আল্লাহর অশেষ রহমতে ৫ অগাস্টের পর সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ স্যারের পিএনজি প্রত্যাহার করে তাঁর সম্মান ফিরিয়ে দেন। এখন তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য হত্যাকান্ডের শিকার শহীদ সেনা অফিসারদের প্রতি ন্যায় বিচার করার জন্য কমিশন চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছেন।
আমাকেও বিগত স্বৈরাচারী সরকার ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনানিবাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। আমিও আমার সকল প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হই। এছাড়া আমার সম্পাদিত জার্নালে যারা বিজ্ঞাপন দিতেন তাদের হুমকি দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সাংবাদিকতার শুরু আমার হাত দিয়ে এবং দেশের একমাত্র প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পত্রিকাটিও আমি চালাতাম। কিন্তু ডিজিএফআই ও সেনা সদর দপ্তর মিলে আমাকেও পিএনজি করে। তাদের কথা ছিল আমি সরকার বিরোধি কথা বলি! বিডিআর ইস্যু নিয়ে আমার জার্নালের কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করায় ও শহীদদের নিয়ে কথা বলায় আমার বিরুদ্ধেও ডিজিএফআই উঠেপড়ে লাগে। আমি ভাবতেও পারিনি যে নিজের কমরেডদের বিরুদ্ধে কেউ ওভাবে কাজ করতে পারে নিজের পদ-পদবী ও সুবিধার জন্য!
সরকার বিরোধি কথা বলা বা সমালোচনা করা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। তারা তাই সংবিধান লংঘন করেছিল বলে আমি মনে করি। আমার পিএনজিও প্রত্যাহার করা হয় অগাস্ট বিপ্লবের পর। আমি আমর প্রিয় কমরেডদের অনেক মিস করেছি পুরো সাড়ে নয় বছর। এখন আবার এসেছি তাদের কাছাকাছি।
অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না যে মিলিটারি একাডেমিতে আমার কোর্সমেট ও রুমমেট জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রধান হওয়ার পরও শুধুমাত্র অবাঞ্ছিত থাকার কারণে আমি তাকে শুভেচ্ছাটা পর্য়ন্ত জানাতে পারিনি, ফোনে কথা বলতে পারিনি। কোর্সমেট বাকি দুই বাহিনী প্রধানের সাথে কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ায় তা অন্তত পেরেছিলাম। রাওয়াতে যেতাম মাঝে মাঝে। সেখানেও ডিজিএফআইয়ের ওয়াচাররা নানা আজগুবি রিপোর্ট করতো।
আমিও সিএমএইচে যেতে পারতাম না। ২০১৫ সালে পিএনজি করার কয়েকদিনের মাথায় আমার একটা অপারেশনের প্রয়োজন হয়। কয়েক লাখ টাকা লাগবে। সিএমএইচ আউট অফ বাউন্ড। এটা শুনে ঢাকার চীনা দূতাবাসের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তৎক্ষনাত আমাকে তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আমার অপারেশন হয় সেখানকার সেনা হাসপাতালে। আমি আমার চিকিৎসা পাইনি আমার দেশের সেনা হাসপাতালে যে দেশটির জন্য কিছুটা হলেও আমার অবদান আছে!
ওহ! ওই একই বছর সৌদি বাদশাহ’র অতিথি হয়ে ওমরাহ করতে যাওয়ার সময় ডিজিএফআই আমাকে বিমান থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। আমার যাওয়া হয়নি।
যাহোক, এসব কষ্ট মেনে নিয়েছি দীর্ঘ সাড়ে নয় বছর। বলতেও পারতাম না কাউকে। কোন ফেসবুক পোস্টও দেইনি। কারণ তাতে যদি প্রিয় সেনাবাহিনীর মানহানি হয়। আমি জীবন গেলেও সেনাবাহিনীর চুল পরিমাণ কোন ক্ষতি হোক তা করিনি, করবোও না কখনো।
আরো অনেক কর্মকর্তাকেও একইভাবে পিএনজি করা হয় যা পুরো সেনাবাহিনীর জন্য ছিল বিব্রতকর। কেউ কিছু বলতেও পারতেন না। দেখা গেছে নিজের কোর্সমেট বড় পদে থাকর পরও ডিজিএফআই ও সরকারের বাঁধার কারনে এসব সমস্যার সমাধান করা যেতো না।
সেনাবাহিনীর মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে এভাবেই কলংকিত করেছিল হাসিনা সরকার ও তার চামচ কতিপয় সেনা কর্মকর্তা। তাদের জন্য পুরো সেনাবাহিনীর ও ডিজিএফআইয়ের বদনাম হয়েছিল। আর যেন কখনো সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা না হয়। (ফেসবুক ওয়াল থেকে)
খুলনা গেজেট/এনএম